মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ উদ্যোগ

মুক্তিযুদ্ধে সহোদর পশ্চিমবঙ্গ

মার্চ, ১৯৭১। ঢাকা উত্তাল, পূর্ববঙ্গ উত্তাল। দিকে দিকে শুধু জয় বাংলা ধ্বনি। দাবি শুধু স্বাধীনতার।

পূর্ববঙ্গের এই উত্তাল সময়ের ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছিল সহোদর পশ্চিমবঙ্গেও। আমাদের এই সহোদর আমাদের স্বাধীনতার পক্ষপাতি ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গনে পূর্ব-বঙ্গের স্বাধীনতা দাবির বিষয়টিই মূখ্য আলোচনার বিষয় ছিল। সত্যি বলতে, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মিত্রতম-মিত্র ছিল পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মানুষরা, যারা আমাদের সহোদর।

২৩ মার্চ, ১৯৭১। সিপিআই কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটটে সভা আহবান করলো। সভার বিষয়বস্তুঃ পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার দাবি ও চলমান আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দান। এই সভায় বক্তৃতা করেন- নাচোলের কৃষক বিপ্লবের নেত্রী ইলা মিত্র, শিক্ষা আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্ত, শ্রমিক নেতা মুহম্মদ ইলিয়াস প্রমুখ। এটি ছিল পূর্ববঙ্গের মুক্তির আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম জনসভা।


এর কয়েকদিন পরেই ২৫ মার্চ রাত থেকে পূর্ববঙ্গের জনগণ পরিণত হলো পৃথিবীর ভয়ংকরতম গণহত্যার ভিক্টিমে। পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা পাকিস্তান ও তাদের দালালদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা হতে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করলো। পশ্চিমবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, আসাম সহ পূর্ববঙ্গ সীমান্তের থাকা ভারতের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য হয়ে উঠলো পূর্ববঙ্গের মানুষদের শেষ আশ্রয়স্থল। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের সহোদররা উদার হৃদয়ে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে জনমত সৃষ্টি করতে এবং পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের সকলে। ৩০ মার্চ, ১৯৭১; কোলকাতায় এরকমই একটি সভা করেছিল শান্তি পরিষদ, পরিচয় ও আফ্রো-এশিয়া সংহতি পরিষদ; এতে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ। এই সভায় মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে বাংলাদেশের জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়- "আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি"।

বাংলাদেশে গণহত্যা তখন সকল সীমা পেরিয়ে গেছে। পাকিস্তান ও তাদের দালালদের হাত থেকে বাঁচতে হাজারে হাজারে বাঙালি ভারতে ঢুকছে। তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছিল, পাকিস্তানীদের ভয়াবহ নির্যাতনের কথা।

৩১ মার্চ, ১৯৭১; গণহত্যার প্রতিবাদে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গে জনগণের স্বতস্ফূর্ত বনধ্ পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের জনগণ, সুশীল সমাজ ও একটিভিস্টদের পাশাপাশি রাজ্য সরকারও এগিয়ে আসে।

০৩ এপ্রিল, ১৯৭১; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় ' বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি'; উদ্দেশ্য- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও উদ্বাস্তুদের সহায়তা করা। কোলকাতার ৩৪ নং ইন্ডিয়ান মিরর স্ট্রিটে এর অফিস করা হয়। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন মূখ্যমন্ত্রী অজয় মূখার্জী, কার্যকরী সভাপতি বিজয় সিং নাহার, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন- বাংলা কংগ্রেসের হরিদাস মিত্র, সিপিআইয়ের অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্ত, কংগ্রেসের ডা. জয়নাল আবেদীন, অরুণ মৈত্র এবং ফরোয়ার্ড ব্লকের অধ্যাপক নির্মল বসু। সম্পাদক মন্ডলীতে ছিলেন- প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্লকান্তি ঘোষ, গোপাল কুমার, কাশীকান্ত মৈত্র, সন্তোষ মোহন রায় ও অরুণেশ দত্ত রায় প্রমুখ।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায়ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও উদ্বাস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়। ০৫ মে, ১৯৭১; পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শান্তি স্বরূপ ধাভান বিধানসভায় গণহত্যা নিয়ে বলেনঃ
".....the exodus of masses of humanity because of the ruthless military operations and what appears to be a deliberate genocide in that part of the subcontinent."
[ পাকিস্তান বাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটন করেছে এবং তাদের হাত থেকে বাঁচতে অসংখ্য মানুষ আজ গৃহহীন-উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন ]

রাজ্যপাল শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দান প্রসঙ্গে বিধানসভায় বলেছিলেনঃ
".....From the last few days of march 1971, there has been an unprecedented influx of people from Bangladesh. .....The continuing influx threatens to be a dislocating factor in the administrative field in our state today, but the policy of my Government and the Union Government shall is to give shelter to all those who seek refuge on the soil of India."
[ একাত্তরের মার্চের শেষাংশ হতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে উদ্বাস্তু আসা শুরু হয়, যা এখনো চলমান। এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুদের আশ্রয়েরর ব্যবস্থা করতে যেয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার হিমশিম খাচ্ছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি হলো, ভারতে মাটিতে আশ্রয়প্রার্থী উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়া হবে।]

পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ও সরকার তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ ও তার জনগণের কল্যাণে। পশ্চিমবঙ্গের জনগণ সস্পর্কে সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী লিখেছেনঃ
"কোলকাতায় তখন প্রতিদিনই মিছিল আর সমাবেশ। শিক্ষক, ছাত্র, শ্রমিক, ডাক্তার এবং বিভিন্ন পেশার মানব-মানবী এতে সামিল। ত্রাণ সংগৃহীত হচ্ছে। সীমান্তের বাঁধা উঠিয়ে দিয়ে উদ্বেলিত মানুষ সংগৃহীত ত্রাণ-সামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে যাচ্ছেন। ইপিআর, পুলিশ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠনের যাকে পাচ্ছেন, তার হাতেই আবেগে ত্রাণসামগ্রী উঠিয়ে দিচ্ছেন।.....যাঁরা কখনো মিছিলে পা মেলাননি, তাঁরা মিছিলে নেমেছেন। যাঁরা কখনও রক্তক্ত দেননিনি, তাঁরা দীর্ঘ লাইন দিয়েছেন রক্ত দেয়ার জন্য। আইএমএ যেদিন রক্তদান কেন্দ্র খোলে, তার প্রথমদিনই এত মানুষ রক্ত দিতে এসেছিলেন যে সকলের রক্ত তারা নিতে পারেননি।"

ভুরুঙ্গামারী মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মুজিব সরকারের সদস্য জাতীয় নেতা এইচ. এম. কামারুজ্জামান ও পশ্চিমবঙ্গের নেতা কমল গুহ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংহতি জানিয়ে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক ও শিল্পীরা। এঁদেরই একটি অংশ গড়ে তুলেছিলেন 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবী সমিতি'। বেশ কয়েকটি সমমনা সংগঠন একত্রিত হয়ে এই সমিতি গঠন করে। এই সংগঠনগুলোর মাঝে ছিলঃ শান্তি সংসদ, প্রগতি লেখক সংঘ, আফ্রো-এশিয়া লেখক সংঘ, পরিচয় পত্রিকা, ভারতীয় গণসংস্কৃতি সংঘ। কোলকাতার ১৪৪ লেনিন সরণির দ্বিতীয় তলায় শান্তি সংসদের অফিসে এই সমিতির কার্যালয় করা হয়। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, সহ-সভাপতি ছিলেন কবি মণীন্দ্র রায়, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মণীন্দ্রলাল বিশ্বাস এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দীপেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ও সন্তোষ ঘোষ। এই সমিতিতে যুক্ত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা। এঁদের মাঝে ছিলেন- সত্যজিৎ রায়, অন্নদাশংকর রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়, প্রসূন বসু, চিত্তরঞ্জন ঘোষ, অন্নদাশংকর ভট্টাচার্য, ড. রমা চৌধুরী, গোবিন্দ হালদার, অমিয় মুখার্জী, দেবেশ রায়, সতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, বাসব সরকার, অমিতাভ দাশগুপ্ত, দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায়, অংশুমান রায়, দিগিন বন্দোপাধ্যায়, রণজিৎ দাশগুপ্ত, মায়া সেন, ধনঞ্জয় দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তুষারকান্তি ঘোষ, সৌরি ঘটক, গোপাল হালদার, দেবনাথ চক্রবর্তী, পূর্বা দাম, অমিতাভ চৌধুরী, নিমর্লেন্দু চৌধুরী, চিন্ময় সেহানবিশ, বিষ্ণু দে, মনোজ বসু, যশোদা সাহা, বিমল ঘোষ, মন্মথ রায়, ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ চৌধুরী, দেবব্রত ভট্টাচার্য, দেবব্রত সেনগুপ্ত, দেবব্রত বিশ্বাস, ঋতু গুহ, তরুণ স্যানাল প্রমুখ।

একাত্তরে মে মাসে বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে গঠিত 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা' গঠনে এই সমিতির অবদান ছিল। শিল্পী সংস্থার সদস্যরা সমিতির অফিসেই রিহার্সেল করতেন। শিল্পী সংস্থার সভাপতি ছিলেন সনজীদা খাতুন ও পরিচালক ছিলেন ওয়াহিদুল হক।

বাঙালি শরণার্থী শিবির ও বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও অর্থ সংগ্রহ করতো এই শিল্পী সংস্থা। 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবী সমিতি' মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন, শরণার্থী শিবিরে সহায়তা করা, পূর্ব বাঙলার শিল্পীদের সহযোগিতা করা, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করেছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনসমর্থন সৃষ্টি ও শরণার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সভা-সমাবেশ-প্রচারণা অভিযান করে যাচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সচেতন সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বরা।

পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের নেতা অধ্যক্ষ রেজাউল করিম (মুর্শিদাবাদ), আবদুস সাত্তার, পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের সুব্রত মুখোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন দাশ মুন্সি, সিপিআই নেতা আবদুর রাজ্জাক খান (চব্বিশ পরগণা), আরএসপি নেতা ত্রিদিব চৌধুরী প্রমুখরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য কাজ করেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের বিপ্লবী নেতারাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ডা. জ্যোতির্ময় গুপ্ত, শিব শংকর মিত্র, ত্রিপুরার মোহন চৌধুরী প্রমুখেন নাম উল্লেখযোগ্য।

এই বিপ্লবীরা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করেছিলেন। শিব শংকর মিত্র লিখিত 'বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও কৌশল' এবং ডা. জ্যোতির্ময় গুপ্ত লিখিত (এম. বসির ছদ্মনামে) 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ' নামে দুটি বই শরণার্থী শিবির ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল; বই দুটোতে গেরিলাযুদ্ধের নানান দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল; বই দুটি সে সময় বাংলাদেশের গেরিলাযোদ্ধাদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল।

দুই দশক আগে দেশভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের যে ভয়াবহ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল, একাত্তরে তা ভুলে গিয়ে মানবতার পথে হেঁটেছিল এই দুই বঙ্গ।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারী ও দালালদের হাতে প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশ) খুন হচ্ছিল, নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছিলেন, উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছেন লাখো মানুষ। পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের এরকম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে সহোদর পশ্চিমবঙ্গীয় ভাইয়েরা চুপ করে থাকতে পারেননি; এগিয়ে এসেছিলেন তাদের সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে।

তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জয়নাল আবেদিন এই প্রসঙ্গে বলেছেনঃ
".....দেশ বিভাগের পর যে ভাবে হিন্দু-মুসলিম বিভক্ত হয়ে পড়েছিল শরণার্থীর ঢেউ এসে তা মুছে গেল। সীমান্তের অপর পারের মানুষের এত দুঃখ কষ্ট দেখে এপারের মানুষ এতই আবেগ ও সহানুভূতিপ্রবণ হয়ে পড়েছিল- তা না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এত হৃদ্যতা দুই সম্প্রদায়ের মানুষ কখনও দেখেনি।"

বাংলাদেশের শরণার্থীরা হাজার মাইল পেরিয়ে জীবন বাঁচাতে ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। মাত্র কয়েকমাসেই শরণার্থীদের সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষ পেরিয়ে যায়, সবমিলিয়ে নয় মাসে ১ কোটি বাঙালি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সীমিত সামর্থ্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আসলে বাস্তবতা হলো, এতো অল্প সময়ে এত বেশি সংখ্যক শরণার্থী সামলানোর অভিজ্ঞতা আধুনিক বিশ্বের ছিল না।

পুরো বিশ্বের মানুষ হতবাক হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী-বিহারি-দালালদের নৃশংসতা দেখে। শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করেছিলেন বাংলাদেশের মানুষরা। খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, আবাসনের ব্যবস্থা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প। রোগ বালাই ছড়িয়ে পড়ে শরণার্থী শিবিরে। শরণার্থী শিবিরে বাঙালির মড়ক ছিল নিত্যকার বিষয়।

পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক, নার্সরা এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের অসুস্থ শরণার্থী, আহত মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তানিদের নির্যাতন হতে পালিয়ে আসতে পারা আহতদের সেবায়। প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসকদের পাশাপাশি বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে হোমোপ্যাথিক চিকিৎসকরাও এগিয়ে এসেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডা. ভোলা চক্রবর্তীর ব্যবস্থাপনায় শরণার্থীদের জন্য স্থাপিত হাসপাতাল ও চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রগুলোতে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য হোমিওপ্যাথি বিভাগ খোলা হয়। পশ্চিমবঙ্গের একজন সব্যসাচী চিকিৎসকের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়, তাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি মেডিক্যাল টিম গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ন'মাস শরণার্থী, মুক্তিযোদ্ধা ও আহতের নিরলসভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন; তাঁর নাম ডা. অনুপম সেন, জলপাইগুঁড়িতে তিনি প্র্যাকটিস করতেন; ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে তিনি টিম নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বাংলাদেশের আহত ও অসুস্থদের সেবা করার জন্য।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের সহযোগীতা ছিল পর্বতসম। তাঁরা আমাদের সহোদর, সবটুকু ভালোবাসা আর সামর্থ্য দিয়ে তাঁরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরের মানুষ ও সরকার আমাদের জন্য নিজেদের সবটুকু নিয়ে পাশে ছিলেন। কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এই অকৃত্রিম বন্ধু-সহোদরকে স্মরণ করি।

তথ্য-সহায়িকাঃ

১. একাত্তরের রাত-দিন - দিলীপ চক্রবর্তী।
২. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান - সালাম আজাদ।
৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা - বিমল প্রামাণিক।
৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র - ১৫ তম খন্ড - অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সাক্ষাৎকার।
৫. পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিবরণী-১৯৭১।

(মার্চ ২৬, ২০১৭-তে নিয়ন আলোয় লিটলম্যাগে প্রকাশিত)

No comments:

Post a Comment

@templatesyard