মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ উদ্যোগ

জিয়ার পদক বাতিলের সিদ্ধান্তঃ ভুল শুধরানোর প্রক্রিয়া

স্বাধীনতা পদক হলো বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। এই পুরস্কার জাতীয় জীবনে গৌরবউজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের নাগরিক এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে প্রদান করা হয়ে থাকে। ২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার জিয়াউর রহমানকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করে। একই বছর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক সম্মাননা দেয়া হয়। স্পষ্টতঃ এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যাক্তিদের একজন জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করা ও বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ করার জন্য বিএনপি'র একটি প্রক্রিয়া।


সম্প্রতি (২৪ আগস্ট, ২০১৬) জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহারের অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আগে এ' বছরের জুলাই মাসে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে একটি নথি কমিটিতে পাঠানো হয়; সেই নথিতে জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতি পদ, রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ এবং নভেম্বর, ১৯৭৫ হতে মার্চ, ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত অসাংবিধানিকভাবে ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি  আদালতের রিট পিটিশন আদেশের মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়। আদালতের রায়ের ভিত্তিতে মন্ত্রীসভা কমিটি তাদের সুপারিশে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনকারী সাব্যস্ত করে বলেছেন-  ‘সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। যেন মানুষ সংবিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ভয় পায়।’ স্বাভাবিকভাবেই অসাংবিধানিক ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রপরিচালনাকারী একজন ব্যাক্তিকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান করা রাষ্ট্রের মূলনীতি ও আর্দশে আঘাত করার সামিল।

তাই, জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক বাতিলের সিদ্ধান্তটি সময়োচিত এবং অতীতের ভুল শুধরানোর একটি যথাযথ প্রক্রিয়া। বিকৃত ইতিহাস প্রচার ও প্রতিষ্ঠার যে বিষবৃক্ষের ধারা বিএনপি চালু করেছিল তাদের সূচনা হতে, সেই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলে সঠিক ইতিহাস চর্চার ধারা পুন:প্রবর্তনের জন্য এই কাজটি অত্যন্ত জরুরি ছিল।

বিএনপি শুধুমাত্র মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। সেসময় সরকারে থাকা বিএনপি জিয়াউর রহমানকে দেয়া এই পুরস্কারের মেডেল ও সম্মাননাপত্র বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষন করে, যাতে বাংলাদেশের ইতিহাস বিতর্কিত এই ব্যাক্তিটি বাঙালির জনমনে দ্রুত প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। এযেন গোয়েবলসীয় নীতি!!! মিথ্যেকে বারবার বললে, প্রচার করলে , তা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়; বিএনপি ঠিক এই কাজটিই করেছিল।

ব্যাক্তিগতভাবে, আমার কাছে জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পদক দেয়া আর হিটলারকে মানবতাবাদী বলা প্রায় সমকক্ষীয়। কারন, আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকা্ই, তবে দেখবো জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতির প্রতি অন্যায় সংঘটনকারী একজন ব্যাক্তি।

অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ ও তা ধরে রাখা বাদে তার কিছু রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ড মনে করা যেতে পারেঃ

১৯৭২ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরে জিয়াউর রহমান নিয়ন্ত্রিত সরকার স্থগিত করে দেয় ও আটককৃত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান অধীনস্ত সরকারের পাপেট রাষ্ট্রপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমের মাধ্যমে দালাল আইন বাতিলকরণ অধ্যাদেশ জারী করা হয়, যার মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত যুদ্ধাপরাধীরা মুক্তি পেয়ে যায় ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের কথা পূর্বেই জানতেন জিয়াউর রহমান, শুধু তাই নয় এবিষয়ে তার সমর্থনও ছিল এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে ছিলেন জড়িত। এন্থনি ম্যাসকারেনহাসকে দেয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক ও আবদুর রশীদের সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টি সুস্পষ্ট।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রু, যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামিকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয় জিয়াউর রহমান। তার শাসনামলে ১৯৭৬ সালের আগস্টে সকল ধরণের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে 'রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা' করা হয়। এইসময় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামক একটি দলের সাথে জামায়াতে ইসলামি যুক্ত ছিল। পরে ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশ গঠন করে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার শত্রু ও যুদ্ধাপরাধী এই সংগঠন বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করে।

যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমনি গোলাম আযম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ পায় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে।১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি তৎকালীন 'জিয়াউর রহমান অধীনস্ত বাংলাদেশ সরকার' এক প্রেসনোট জারি করে, যাতে 'নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে' এমন ব্যাক্তিরা তাদের নাগরিকত্ব ফিরে পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পাবে। গোলাম আযম নাগরিকত্ব ফিরে পাবার জন্যে আবেদন করে। গোলাম আজমের মত রাজাকার-শিরোমনিকে নাগরিকত্ব দেবার সাহস 'জিয়াউর রহমান অধীনস্ত প্রোপ-পাকিস্তানী সরকার' করেনি, তবে তারা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' পদ্ধতি অবলম্বন করে। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার গোলাম আযমকে তিনমাসের জন্য বাংলাদেশের ভিসা দেয়; কারন হিসেবে দেখানো হয়, তার মা অসুস্থ। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট গোলাম আযম পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে বাংলাদেশ। এর নেতৃত্বে ছিল জিয়াউর রহমান, তিনি পরিবর্তন করতে চেয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা। ১৯৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সমর্থকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, হিন্দুর লেখা জাতীয় সঙ্গীত ও ইসলামী তাহজ্জীব ও তমুদ্দুন বিহীন জাতীয় পতাকা পরিবর্তন করা হবে।

জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়সৃত্মি তুলে দিয়েছিল পাকিস্তানিদের হাতে। তার শাসনামলে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে একজন পাকিস্তানি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ভাইকে তৎকালীন ০৬ কোটি টাকা মূল্যমানের S.S. Lightening জাহাজটি উপহার দেয়া হয়; এই জাহাযটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের একটি সৃত্মিচিহ্ন।

জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে ক্লিনজিং চালিয়েছিলেন সামরিক বাহিনীতে। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৭৮ সালের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের পরবর্তীতে সময়ে জিয়াউর রহমান সরকার সন্দেহের তালিকায় থাকা যেকারো বিরুদ্ধেই চুড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতো।

এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মাঝে ভূমি নিয়ে যে বিরোধ ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির আগে বিরাজমান ছিল, যা চরম সহিংসতার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, তার সূচনাও হয় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে; সে সময় ভূমিহীন, বাস্তুহীন, নদীভাঙা পীড়িত ও দরিদ্র বাঙালিদের অপরিকল্পিত পুনর্বাসন দেয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে, যার ফলশ্রুতিতে শুর হয়েছিল প্রায় দুই দশকের বাঙালি-পাহাড়ি জাতিগত সহিংসতার।

এইরকম আরো অসংখ্য 'বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতি' বিরোধী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিল জিয়াউর রহমান। এইরকম একজন কলঙ্কিত ব্যাক্তিকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা রাষ্ট্র ও জাতির জন্য লজ্জাজনক ও জাতীয় নৈতিক স্খলন। বর্তমান গলতান্ত্রিক সরকারের জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে ধন্যবাদ জানাই অবৈধ-অসাংবিধানিক শাসক জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক বাতিলের সুপারিশ আনয়নের জন্য। জাতীয় নৈতিকতা অক্ষুন্ন রাখা ও সঠিক ইতিহাস জাতিকে জানানোর বিষয়ে জিয়াউর রহমানের মত কলঙ্কিত ব্যাক্তি স্বাধীনতা পদক বাতিলের সিদ্ধান্ত যথাযথ ও যুগোপযোগী।

আপডেটঃ

২৭ আগস্ট, ২০১৬ঃ
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি। খবর- প্রথম আলো।

০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ঃ
সরকারের সিদ্ধান্তের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে দেওয়া স্বাধীনতা পদক জাতীয় জাদুঘর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

বিডি নিউজ-এ সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment

@templatesyard