সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে কিন্তু পাকিস্তান সামরিক সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি বরং বাঙালি জাতিকে কি করে চিরদিনের মত অনুগত করে রাখা যায়, তার পরিকল্পনা করে। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল নির্যাতন মাধ্যমে বাঙালি জাতির মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া যাবে, বাঙালিদের দাবিয়ে রাখা যাবে; তাহলে, বাঙালি জাতি ক্ষমতার অংশীদারীত্ব দাবি করবে না। আর এই নোংরা ভাবনা হতেই একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের গণহত্যা ও নির্যাতন করার পরিকল্পনা করে।
একাত্তরের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের সিন্ধুর লারকানার গোপন বৈঠকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভূট্টো ও পাকিস্তানের জেনারেলরা সিদ্ধান্ত নেয় সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। লারকানার সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গণহত্যা ও নির্যাতনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে ধুলিস্মাৎ করতে হবে। তারা এই লক্ষ্যে পূর্ব-পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) সামরিক অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়; যার নাম ‘অপারেশান সার্চলাইট’।
লারকানার গোপন বৈঠকে ভূট্টো, ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানি জেনারেলরা পূর্ব-পাকিস্তান সমস্যার সমাধান হিসেবে সাধারণ বাঙালি জনতার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই অপারেশান বাস্তবায়নে ‘বালুচিস্তানের কসাই’ বলে খ্যাত পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব-পাকিস্তান সামরিক কমান্ডের প্রধান করা হয়। হত্যা ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে জনআন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার অভিজ্ঞতা বালুচিস্তানে টিক্কা খানের হয়েছিল। অর্থাৎ, গণহত্যা ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখতে পাকিস্তান যোগ্য ব্যাক্তিকেই নিয়োগ করেছিল।
‘অপারেশান সার্চলাইট’ ছিল বাঙালি জাতিকে গণহত্যা ও নির্যাতন করার একটি অভিযান; এবিষয়টি জেনারেল টিক্কা খানের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে এসেছে। জেনারেল টিক্কা ‘অপারেশান সার্চলাইটে’ অংশ নেয়া সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বলতেন-
“আমার মাটি চায়, মানুষ না।”
জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারণ জনতাকে হত্যা-নির্যাতনের আদেশ দিয়েছিলেন। টিক্কার এই আদেশগুলো মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার জানজেব আরবাব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। একাত্তরে বাঙালি গণহত্যার আরেক কসাই, বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের একজন প্রধানতম রূপকার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়রিতে লিখেছেন-
“পূর্ব-পাকিস্তানের সবুজ ভূখন্ড লাল করে দেয়া হবে।”
এই ডায়েরিটির কথা জেনারেল নিয়াজী তার বই ‘বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানে’ উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ঢাকায় গর্ভনর হাউজে মুক্তিযোদ্ধারা এই ডায়েরির কিছু পাতা উদ্ধার করেছিলেন। সেখানে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের কথা ছিল।
একাত্তরের গণহত্যার রূপকার পাকিস্তানি জেনারেল ও রাজনীতিক
প্রথম সারি (বাম হতে)- প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভূট্টো, জেনারেল টিক্কা খান
দ্বিতীয় সারি (বাম হতে)- জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা
‘অপারেশান সার্চলাইট’ বাস্তবায়নে পূর্ব-পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পশ্চিম-পাকিস্তানি সৈন্য সংগঠিত করতে শুরু করে পাকিস্তানিরা। মার্চ, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যে আলোচনায় বসেছিলেন, তা ছিল মূলতঃ পাকিস্তানি কৌশল। আলোচনায় বাঙালিকে ব্যস্ত রেখে এই সময়ে পূর্ব-পাকিস্তানে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছিল।
পাকিস্তানি জেনারেলরা এটা অনুমান করতে পেরেছিল যে, ‘অপারেশান সার্চলাইটের’ মত নিপীড়নমূলক সামরিক অভিযান শুরু করলে সামরিক বাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী থাকা বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করবে। তাই, পাকিস্তানিরা প্রতিরাতে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিমানে করে পশ্চিম-পাকিস্তান হতে পূর্ব-পাকিস্তানে বেসামরিক পোষাকে ২২ বালুচ ও ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের সৈন্য এনেছিল। এই পুরো বিষয়টি করা হয়েছিল গোপনে, তাই পূর্ব-পাকিস্তানে পশ্চিম-পাকিস্তানি সৈন্য সংগঠিত করার কাজে সামরিক বাহিনীর কোন বাঙালি অফিসারকে জড়িত করা হয়নি।
প্রতিরাতে বেসামরিক পোষাকে পশ্চিম-পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহারে পূর্ব-পাকিস্তানে আগমন খেয়াল করে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বাঙালি ক্রু-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা; তারা এইসব ফ্লাইটে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের দুজন বাঙালি ক্রু সৈন্য বহনকারী একটি বোয়িং বিমান বিস্ফোরণ ঘটাতে চেয়েছিল কিন্তু পাকিস্তান বিমান বাহিনীর গোয়েন্দারা বিস্ফোরন ঘটানোর আগেই তাদের ধরে ফেলে। এই ঘটনার পরে বিমানবন্দর পরিচালনা ও ফ্লাইট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাকিস্তান বিমানবাহিনী নেয়।
বিমানে করে আসা এই সৈন্যরা নিজেদের সাথে হালকা অস্ত্র বহন করতো। অপরেশান সার্চলাইটের জন্য ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমুদ্রপথে আনা হয়েছিল। এমভি সোয়াত নামে একটি জাহাজে সাত হাজার টন গোলাবারুদ আনা হয়। রংপুর হতে ২৯ ক্যাভালরি ছয়টি এম-২৪ ট্যাংক নিয়ে ঢাকা এসেছিল।
‘অপারেশান সার্চলাইট’ বাস্তবায়নে ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট) ও পুলিশ যাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, তাই ঢাকার পিলখানায় অবস্থিত ইপিআরের সদর দফতর, রাজারবাগে অবস্থিত পুলিশের সদর দফতর আক্রমনের পরিকল্পনা করেছিল পাকিস্তানি। তাই, ২৫ মার্চ শেষ প্রহরে পাকিস্তানিদের বাঙালি-গণহত্যা অভিযান শুরু করার সময়ই পিলখানা ও রাজারবাগে নৃশংস হত্যাকান্ড চালায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের জন্যও পরিকল্পনা করে রেখেছিল পাকিস্তানিরা- সৈন্য ও বিদ্রোহী অফিসারদের হত্যা করা।
অবশেষে আসে সেই কালো দিন- ২৫ মার্চ, ১৯৭১। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে যান। যাবার আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানের ঢাকাস্থ বাসভবনে টিক্কা খান ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর জেনারেল হামিদ, মিথা, ইফতেখার, খুদা দাদ, রাও ফরমান আলীদের সাথে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে চুড়ান্ত বৈঠক করা হয়; সন্ধ্যা ০৬ টায় অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ‘অপারেশান সার্চলাইটের’ জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। সন্ধ্যা হতেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ঢাকা শহর, চট্টগ্রাম শহর সহ পূর্ব-পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
এরপরের ঘটনাগুলো মানব ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করে। পাইকারীভাবে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের গণহত্যা ও নির্যাতন করে। এর ব্যাপকতা ও বিভৎসতা এতটাই ভয়াবহ যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজ পর্যন্ত এটি সবচেয়ে ভয়াবহতম গণহত্যা।
রাত সাড়ে দশটায় পাকিস্তানি সৈন্যরা রেডিও- টিভি স্টেশন দখল করে নেয়। এর এক ঘন্টা পর রাত সাড়ে এগারোটা হতে শুরু হয় নির্বিচারে সাধারণ ঘুমন্ত বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে পূর্ণ মাত্রার সামরিক অভিযান। ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ পূর্ব-পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে বাঙালি-গণহত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ঢাকার পিলখানার ইপিআর সদর দফতর, রাজাবাগের পুলিশ সদর দফতর, চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টালে (ইবিআরসি) বাঙালি সৈন্য, অফিসার ও পুলিশকে হত্যার উৎসব শুরু হয়। রাত বারোটার কিছু পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
২৫ মার্চ কালোরাতে 'অপারেশন সার্চলাইটে' পাকিস্তানি হাতে নিহত নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি
‘অপারেশন সার্চলাইটের’ মধ্য দিয়ে শুরু পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে আক্রমন করে, গণহত্যা করে। ফলশ্রুতিতে সূচনা হয় বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের শেষ ধাপ- মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চের সেই কালো রাতে বিচ্ছিন্নভাবে নিরস্ত্র বাঙালি রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সামরিক, আধা-সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালির সদস্যরা প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সংগঠিত হতে শুরু করে। পরদিন ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে বেতার হতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে শোনান আওয়ামীলীগ নেতা এম. এ. হান্নান। এদিকে নিরস্ত্র বাঙালি হত্যার কালো উৎসব পালন উদযাপন করছিল বর্বর পাকিস্তানিরা, তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল বিহারি ও দালালেরা।
এই গণহত্যার অন্যতম প্রধান রূপকার পাকিস্তানি রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভূট্টো সেদিন ঢাকায় রয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কতটা নির্মমতা ও বিভৎসতার সাথে বাঙালিকে জাতিগত ধোলাই করতে পারে, লারকানার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে। নিয়াজী তার বইতে এসম্পর্কে লিখেছেন-
“অপারেশন সার্চলাইটে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে ঢাকা পোড়ার দৃশ্য ভূট্টো দেখেছেন, বাঙালির আর্তচিৎকার শুনেছেন।”
সহায়ক সূত্রঃ
• The Betrayal of East Pakistan Book -Amir Abdullah Khan Niazi – বই।
• Witness to surrender Book - Siddique Salik – বই।
• A Stranger in my own Country - Khadim Hussain Raja – বই।
• How Pakistan got divided - Rao Farman Ali Khan – বই।
পাকিস্তানীরা অমানুষ
ReplyDeleteগনহত্যা বলার আগে গনহত্যার সংজ্ঞাটা জেনে আসিস, তার পর সর্মিলা বসুর ডেড রেকনিং বইটা পড়ে নিস। আর যদি চুলকায় তাহলে তোর বাপকে বলিস তোর পাছায় যেন কানাওয়ালা বাঁশ হান্দায়া দেয়।
ReplyDelete